বাঙালির আত্মগৌরবের স্মারক অমর একুশের প্রথম প্রহর থেকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হচ্ছে মহান ভাষা শহীদদের। মধ্য রাতের পর সর্বস্তরের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে বাঙালির স্মৃতির মিনার শহীদ মিনার।
দিবসের প্রথম প্রহরে ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেমেছে হাজারও মানুষের ঢল। ছোট্ট শিশুটি থেকে শুরু করে অশীতীপর মানুষটিও এসেছেন শহীদ মিনারে, অমর শহীদদের প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত ভালোবাসা ও আর শ্রদ্ধা জানাতে। ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান- কেউ বাদ যায়নি। সবাই এসেছে ফুল আর ব্যানার হাতে। অমর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ফুল নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশিরাও। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শহীদ মিনার এলাকা ত্যাগ করলে সেখানে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। এ সময় সাধারণ মানুষ দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এদিকে শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে শহীদ মিনার এলাকা কঠোর নিরাপত্তার চাঁদরে ঢেকে রাখা হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়।
মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২ সালে জীবন দিয়েছিল সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকে। তাদের রক্তের বিনিময়েই আজকে মুখে মুখে বাংলা ভাষা। বাংলায় রচিত হচ্ছে হাজারো গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস আর অজস্র কথামালা। আজকের দিনটি শুধু সেই বীর ভাষাসৈনিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর, যারা ভাষার জন্য অকাতরে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আজকের দিনটি কেবল বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের সব প্রান্তে পালিত হবে বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুভেজা অমর একুশে। বাঙালির রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এরপর থেকেই যথাযোগ্য মর্যাদায় সারা বিশ্বে একযোগে পালিত হয়ে আসছে দিনটি।
৬৪ বছর আগের এই দিনে বাংলার সংগ্রামী ছেলেরা যে ত্যাগ ও গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন, তারই পথ ধরে আমরা মুখোমুখি হই স্বাধীনতা সংগ্রামে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাভ করি লাল সবুজের পতাকা। ১৯৫২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালি রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে হরতালের প্রস্তুতি চলতে থাকে। সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টায় একটানা এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র হরতাল, সভা, মিছিলের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। এসব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছাত্ররা দলে দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয়।
ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রদের সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিকল্পনা করা হয়, চারজন চারজন করে মিছিল নিয়ে বের হওয়ার। ছাত্ররা মিছিল শুরু করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে তুলতে থাকে। বিকেল ৩টায় গণপরিষদের অধিবেশনের আগেই শুরু হয়ে যায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। বিকাল ৪টায় পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। বুলেট কেড়ে নেয় জব্বার ও রফিকের প্রাণ। গুলিবিদ্ধ আবুল বরকত রাত পৌনে আটটায় হাসপাতালে মারা যান।
তাদের মৃত্যু সংবাদে বাংলা ভাষার প্রাণের দাবি সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
Post a Comment