রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে তিনি বরাবরই দেখেছেন এক অন্য দৃষ্টিতে। তারপরও কবি জীবনে অন্তত একবার আত্মহননের কথা ভেবেছিলেন। সময়টা গ্রীষ্মের সময়। কবি তখন ভারতের রামগড়ে বাস করতেন।
কবির মন বেশ প্রসন্ন। এক মালির ছেলের কাঁপুনি রোগ ছিল। কবি নিজে তাকে ওষুধ দিলেন। রোগ সেরেও গেল। কবির ডাক্তার হিসেবেও নাম ছড়িয়ে পড়ল। এ সময়ই হঠাৎ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন কবি। বিশ্বের পরিস্থিতি হোক, কিংবা অন্তর্দ্বন্দ্ব, কবির মন যেন বিষাদের ঘন মেঘে ঢাকা। এর কিছুদিন পরই বাধবে প্রথম মহাযুদ্ধ। বিশ্বের এই পরিস্থিতিতে কবি আঘাত পেয়েছিলেন। প্রার্থনা করেছিলেন এই ‘বিশ্বপাপ’কে দূর করার। এদিকে এই সময় তার সাহিত্যও নতুন বাঁক নিয়েছে। লেখা হয়ে গেছে স্ত্রীর পত্রর মতো গল্প। চতুরঙ্গ ঘরে বাইরের মতো লেখার জন্য কবিকে ‘অনেক নামজাদা লেখকের কাছ থেকে অনেক রূঢ় বাক্য শুনতে হয়েছিল।’ এর মধ্যেই আবার ব্যক্তিগত বিপর্যয় তো আছেই। আগে পশ্চিমবঙ্গের সুরুলে প্রায় ২০ হাজার রুপি ব্যয়ে বাড়ি ও জমি কিনে শিলাইদহের পাট চুকিয়ে চলে এসেছিলেন। কিন্তু ম্যালেরিয়ার জন্য সে স্থান ছাড়তে হল। সুরুলের স্বপ্ন অধরা থেকে গেল। গ্রাম সংস্কার থেকে কৃষিকার্যে গবেষণা ইত্যাদির যে পরিকল্পনা ছিল তা সব ‘আকাশকুসুম’ বলে মনে হতে থাকল। রামগড় থেকে ফেরার পর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে ‘মরবার ইচ্ছা’ কীভাবে তার মনকে গ্রাস করেছিল সে কথা জানান কবি। নিজেকে ‘আগাগোড়া ব্যর্থ’ মনে হয়েছিল তার। জানিয়েছিলেন, ‘নিজের উপর এবং সংসারের উপর আমার গভীর অশ্রদ্ধা ঘনিয়ে আসছিল।’ নিজের আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি বলেই ব্যথিত ছিলেন কবি। সম্ভবত কর্মজীবনের এই ব্যর্থতা তাকে গ্রাস করেছিল। আর তাই আত্মহননের কথাও ভেবেছিলেন কবি। সে সময় কবি নোবেল পেয়েছেন, সারা বিশ্বে তিনি সম্মানিতও। মাতৃবিয়োগ, নতুন বৌঠানের চলে যাওয়া, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মৃত্যুও যাকে টলাতে পারেনি, কর্মজীবনের ব্যর্থতাই সম্ভবত তাকে তার ধ্যান থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। জীবনে বহু শোক পেয়েছেন। কিন্তু শোককে কখনও জীবনের উপর জায়গা দেননি। মৃত্যু, শোক দহনের পরেও যে অনন্ত জাগে তারই সন্ধান করেছেন কবি। আমৃত্যু বিশ্বাস রেখেছেন তাতে। তবু সে সবেরই মাঝে এ যেন অচেনা এক রবীন্দ্রনাথ। এবং এখানেও তিনি পথপ্রদর্শকই। নিদারুণ এই হতাশা অতিক্রম করেও কী করে যে জীবনে আদর্শের সাফল্যে পৌঁছানো যায়, তাও দেখিয়েছিলেন তিনিই।
Post a Comment